
হজ্জ ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ এবং এটি প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য জীবনে একবার ফরজ। হজ্জ একটি মহান ইবাদত, যা ইসলামের মূল ভিত্তির অন্যতম অংশ। এটি মুসলমানদের আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধি এবং আত্মবিশ্লেষণের সুযোগ প্রদান করে। হজ্জের ফরজ (রুকন) হলো এমন কাজ, যা ছাড়া হজ্জ শুদ্ধ হয় না। হজ্জের ফরজ সংখ্যা ৪টি এবং ওয়াজিব ৬টি। হজ্জের ফরজ এবং ওয়াজিব গুলোর বিস্তারিত আলোচনা নিচে করা হলো:
ফরজ
১. ইহরাম বাঁধা:
- ইহরাম কী?: ইহরাম হলো হজ্জ বা উমরাহ করার জন্য বিশেষ পোশাক পরিধান করা এবং কিছু নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকা। পুরুষরা দুইটি সেলাইবিহীন কাপড় পরেন, আর মহিলারা সাধারণ পোশাক পরেন, যা শরীয়ত মেনে থাকে।
- ইহরামের নিয়ত: ইহরাম বাঁধার সময় হজ্জ বা উমরাহের নিয়ত করতে হয়। নিয়তের সাথে "তালবিয়া" পাঠ করা সুন্নত। তালবিয়া হলো:
- لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ، لَبَّيْكَ لَا شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ، إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ، لَا شَرِيكَ لَكَ
- অর্থ: "হে আল্লাহ! আমি আপনার ডাকে সাড়া দিলাম, আমি আপনার ডাকে সাড়া দিলাম। আপনার কোনো শরিক নেই, আমি আপনার ডাকে সাড়া দিলাম। নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা, নিয়ামত ও রাজত্ব আপনারই। আপনার কোনো শরিক নেই।"
২. আরাফাতের দিন আরাফাত ময়দানে অবস্থান করা:
- আরাফাতের দিন: ৯ই জিলহজ তারিখে আরাফাত ময়দানে অবস্থান করা হজ্জের একটি প্রধান ফরজ। এই দিনটি হজ্জের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন।
- সময়: জিলহজ মাসের ৯ তারিখে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাত ময়দানে অবস্থান করা ফরজ। যদি কেউ এই সময়ের মধ্যে কিছুক্ষণের জন্যও আরাফাত ময়দানে অবস্থান করে, তার হজ্জের ফরজ আদায় হয়ে যাবে।
- মহিমা: হাদিসে বলা হয়েছে, "হজ্জ হলো আরাফাত।" (তিরমিজি)
৩. তাওয়াফে জিয়ারত করা:
- তাওয়াফ কী?: তাওয়াফ হলো কাবা শরিফকে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ৭ বার প্রদক্ষিণ করা।
- তাওয়াফে জিয়ারত: হজ্জের সময় তাওয়াফে জিয়ারত করা ফরজ। এটি সাধারণত ১০ই জিলহজ তারিখে বা এর পরবর্তী দিনগুলোতে সম্পন্ন করা হয়।
- নিয়ম: তাওয়াফের সময় পবিত্রতা (ওজু) থাকা আবশ্যক। তাওয়াফের শুরুতে হাতিমের কাছে এসে "বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার" বলে তাওয়াফ শুরু করতে হয়।
৪. সাঈ করা:
- সাঈ কী?: সাঈ হলো সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে ৭ বার যাতায়াত করা।
- সাঈর নিয়ম: সাফা পাহাড় থেকে শুরু করে মারওয়া পাহাড়ে গিয়ে একবার এবং মারওয়া থেকে সাফায় ফিরে আসলে আরেকবার। এভাবে মোট ৭ বার সম্পন্ন করতে হয়।
- মহিমা: সাঈ হজ্জ ও উমরাহর একটি ফরজ কাজ। এটি হযরত হাজেরা (আ.)-এর স্মৃতির সাথে সম্পর্কিত।
হজ্জের ফরজ ছেড়ে দিলে করণীয়:
যদি কেউ হজ্জের কোনো ফরজ ছেড়ে দেয়, তাহলে তার হজ্জ শুদ্ধ হবে না এবং তাকে পরবর্তী বছর আবার হজ্জ করতে হবে। তবে যদি কোনো ফরজ কাজ আদায় করতে না পারার কারণ অনিচ্ছাকৃত হয় (যেমন: অসুস্থতা বা অন্য কোনো বাধা), তাহলে তার জন্য আলেমদের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
ওয়াজিব
হজ্জের ওয়াজিব হলো এমন কাজ, যা হজ্জের ফরজ বা রুকন নয়, তবে এগুলো পালন করা আবশ্যক। যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে বা ভুলবশত ওয়াজিব ছেড়ে দেয়, তার হজ্জ শুদ্ধ হবে, তবে তাকে দম (কুরবানি) বা অন্যান্য কাফফারা আদায় করতে হবে। হজ্জের ওয়াজিব সংখ্যা বিভিন্ন মাযহাব অনুযায়ী কিছুটা ভিন্ন হতে পারে, তবে সাধারণভাবে হানাফি মাযহাব অনুসারে হজ্জের ওয়াজিব ৬টি। নিচে হজ্জের ওয়াজিবগুলো উল্লেখ করা হলো:
১. ইহরাম বাঁধার স্থান (মীকাত) থেকে ইহরাম বাঁধা:
- হজ্জ বা উমরাহ করার জন্য মীকাত থেকে ইহরাম বাঁধা ওয়াজিব। মীকাত হলো নির্দিষ্ট সীমানা, যা অতিক্রম করার আগেই ইহরাম বাঁধতে হয়। যেমন: মক্কা থেকে মদীনার দিকে যাওয়ার সময় জুল-হুলাইফা (আবিয়ার আলী), ইরাকের দিকে যাওয়ার সময় যাতু ইরক ইত্যাদি।
২. আরাফাতের দিন সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাত ময়দানে অবস্থান করা:
- ৯ই জিলহজ তারিখে আরাফাতের দিন সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাত ময়দানে অবস্থান করা ওয়াজিব। যদি কেউ সূর্যাস্তের আগে আরাফাত ছেড়ে চলে যায়, তাহলে তার হজ্জ শুদ্ধ হবে না।
৩. মুজদালিফায় রাতযাপন করা:
- ৯ই জিলহজ তারিখে রাতের বেলা মুজদালিফায় অবস্থান করা ওয়াজিব। সাধারণত ফজরের নামাজ আদায়ের পর সূর্যোদয়ের আগেই মিনার দিকে রওনা হওয়া হয়।
৪. জামারাতে শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ (রমি):
- ১০ই জিলহজ তারিখে জামারাতুল আকাবায় ৭টি পাথর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব। এরপর ১১ই, ১২ই ও ১৩ই জিলহজ তারিখে তিনটি জামারাতে (জামারাতুল উলা, জামারাতুল ওস্তা ও জামারাতুল আকাবা) প্রতিদিন ৭টি করে পাথর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব।
৫. মাথা মুণ্ডন বা চুল ছাঁটা:
- ১০ই জিলহজ তারিখে কুরবানির পর পুরুষদের জন্য মাথা মুণ্ডন বা চুল ছাঁটা ওয়াজিব। মহিলাদের জন্য চুলের কিছু অংশ কাটা ওয়াজিব।
৬. তাওয়াফে জিয়ারত করা:
- হজ্জের তাওয়াফ (তাওয়াফে জিয়ারত) করা ওয়াজিব। এটি হজ্জের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং এটি ছাড়া হজ্জ সম্পূর্ণ হয় না। সাধারণত ১০ই জিলহজ তারিখে বা এর পরবর্তী দিনগুলোতে এই তাওয়াফ সম্পন্ন করা হয়।
ওয়াজিব ছেড়ে দিলে করণীয়:
যদি কেউ ইচ্ছাকৃত বা ভুলবশত ওয়াজিব ছেড়ে দেয়, তাহলে তার হজ্জ শুদ্ধ হবে, তবে তাকে দম (কুরবানি) আদায় করতে হবে। দম হলো একটি ছাগল বা ভেড়া কুরবানি করা। যদি কুরবানির সামর্থ্য না থাকে, তাহলে ১০টি মিসকিনকে খাবার দান করতে হবে বা ৩ দিন রোজা রাখতে হবে।
হজ্জের ওয়াজিবগুলো সঠিকভাবে পালন করা হজ্জের পূর্ণতা অর্জনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তাআলা সকল হাজী সাহেবদের হজ্জ মকবুল করুন এবং তাদের সকল পাপ মাফ করে দিন।