কাবা শরীফ: এক ঐতিহাসিক নিদর্শন
পবিত্র কাবা শরীফ ইসলামের পবিত্রতম স্থাপনা এবং পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিচিত। এটি শুধু মুসলমানদের কেবল ইবাদতের দিকনির্দেশক কিবলা নয়, বরং ইসলামের গভীর ইতিহাসের সাক্ষী। কাবার নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ এবং সংরক্ষণ নিয়ে এক বিস্তৃত ইতিহাস রয়েছে যা মানবজাতির আদি যুগ থেকে শুরু হয়ে আজ পর্যন্ত বিদ্যমান।
বিশ্বাস করা হয়, ফেরেশতাগণ সর্বপ্রথম কাবা নির্মাণ করেছিলেন, যা মানবজাতির সৃষ্টি পূর্বেই স্থাপিত হয়েছিল। অতঃপর প্রথম মানব ও নবী হযরত আদম (আঃ) পুণরায় একই স্থানে কাবা নির্মাণ করেন। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে কাবা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। বিশেষত, হযরত নূহ (আঃ)-এর মহাপ্লাবনের সময় পবিত্র কাবা প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
পরে আল্লাহ তাআলা হযরত ইবরাহীম (আঃ)-কে নির্দেশ দেন পবিত্র কাবা পুনর্নির্মাণ করার জন্য। কোরআনুল কারিমে এই ঘটনাটি উল্লেখ করা হয়েছে:
"যখন আমি ইবরাহীমকে কাবার স্থান নির্দেশ করলাম এবং এও বললাম যে, আমার সঙ্গে কাউকে শরিক করো না এবং আমার ঘরকে তাওয়াফকারী ও নামাজ আদায়কারীদের জন্য পবিত্র রাখো।" (সূরা আল-বাকারা)
ইবরাহীম (আঃ) ও তাঁর পুত্র হযরত ইসমাঈল (আঃ) একত্রে পবিত্র কাবা নির্মাণ করেন। নির্মাণ শেষে, ফেরেশতা হযরত জিবরাঈল (আঃ) জান্নাত থেকে হাজরে আসওয়াদ নিয়ে আসেন এবং তা কাবার দেয়ালে স্থাপন করেন।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেন, "হাজরে আসওয়াদ জান্নাতের একটি পাথর, যা পৃথিবীতে আগমনের সময় বরফের মতো শুভ্র ছিল। কিন্তু মানবজাতির পাপের কারণে এটি কালো হয়ে গেছে।"
ইবরাহীমী নির্মাণের বহু বছর পর, কোরায়েশদের সময়ে কাবা একটি অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন কোরায়েশরা কাবা পুনর্নির্মাণে উদ্যোগী হয়। তারা ইবরাহীমী ভিত্তির কিছু অংশ পরিবর্তন করে কাবার কাঠামো নির্মাণ করে। তবে সেই সময় হাজরে আসওয়াদ স্থাপনের সময় কোরায়েশ গোত্রদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। পরে মহানবী (সাঃ)-এর দূরদর্শী সিদ্ধান্তে মতবিরোধ সমাধান হয় এবং হাজরে আসওয়াদ যথাযথভাবে স্থাপিত হয়।
মক্কা বিজয়ের পর মহানবী (সাঃ)-এর পদক্ষেপ
মক্কা বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কাবা থেকে সব মূর্তি অপসারণ করেন এবং তা পবিত্র করেন। তবে তিনি ইবরাহীমী ভিত্তির উপর পুনর্নির্মাণ করার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তা করেননি। কারণ, নবীন মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনো বিভ্রান্তি সৃষ্টি হোক, তা তিনি চাননি।
খলিফা ওমর (রাঃ)-এর সংস্কার
দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) তাঁর খেলাফতের সময় মসজিদুল হারামের আয়তন বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি মসজিদ সংলগ্ন জমি ও বাড়ি ক্রয় করে মসজিদের পরিসর বৃদ্ধি করেন এবং মাতাফ (তাওয়াফের স্থান) সম্প্রসারণ করেন। এর পাশাপাশি মাকামে ইবরাহীম, যা পূর্বে কাবার দেয়ালের সঙ্গে ছিল, তা স্থানান্তর করে একটি নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করেন।
খলিফা উসমান (রাঃ)-এর অবদান
তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান ইবনে আফফান (রাঃ) ২৬ হিজরীতে মসজিদের আরও সম্প্রসারণ করেন। তাঁর শাসনামলে মসজিদের সৌন্দর্য ও পরিসর বৃদ্ধি পায়।
ইসলামের স্বর্ণযুগে এবং খলিফাদের শাসনামলে পবিত্র কাবা ও মসজিদুল হারামের বহুবার পুনর্নির্মাণ ও সম্প্রসারণ হয়েছে। বিভিন্ন যুগে মুসলিম শাসকেরা কাবার সৌন্দর্য বৃদ্ধি এবং তাওয়াফকারীদের জন্য সুবিধার ব্যবস্থা করেছেন। আধুনিক যুগে সৌদি আরব সরকার মসজিদুল হারামের ব্যাপক সম্প্রসারণ করেছে, যা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত হাজিদের সুবিধা প্রদান করে।
কাবা শরীফ শুধুমাত্র একটি স্থাপনা নয়; এটি মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, ইতিহাস এবং ঈমানের প্রতীক। হাজার হাজার বছর ধরে এটি ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। আজও কাবা শরীফ আমাদের ঈমানের কেন্দ্রস্থল এবং আল্লাহর প্রতি আমাদের আনুগত্যের প্রকাশ।